অজয় দাশগুপ্ত: যৌবনে ১৭ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি পর্দায় যে ম্যারাডোনার খেলা দেখে আর্জেন্টিনার ভক্ত হয়েছি তাঁর জীবনের সবটাই এক ইতিহাস। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এক অলৌকিক ফুটবল প্রতিভা। তাঁর জীবন, তাঁর উঠে আসার বিরুদ্ধে কতো শক্তিশালী মাফিয়া, মিডিয়া ও দেশ কাজ করেছিলো। কিন্তু ম্যারাডোনা তো ম্যারাডোনাই। কিউবার ক্যাস্ট্রোর বন্ধু হওয়া, চে গুয়েভারার দেশের এই ফুটবলার ছিলেন না মনে হয়? ঠিকই ছিলেন। ছায়ার মতো দৌড়েছেন মাঠে। অদৃশ্য ম্যারাডোনাই ভর করে হয়ে উঠেছিল নতুন মেসি। মেসিও সোনার চামচ মুখে জন্মায়নি। তাকেও উঠে আসতে হয়েছে কঠিন পরিশ্রম করে। প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সের কালো মানিকও শ্রম এবং কঠিন সংগ্রামে গড়া। আমাদের অন্ধ সমর্থক বা সমর্থন এসব জানলেও এ থেকে শিক্ষা বা এর অনুসরণ করে না। করলে সমর্থন শক্তিতে পরিণত হতো। খেলার পর এ কথা বলতেই হবে আমরা যারা সাধারণ সাপোর্টার, আপনাদের মতো ক্ল্যাসিক বা এলিট দলগুলো সমর্থন করি না, তারাই জয়ী হয়েছি। সেমি ফাইনালের পর এখনকার জনপ্রিয়তম ব্যস্ত লেখক সাদাত হোসাইনের সাথে কথা হচ্ছিল। ওর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াগুলো মজার, দেখতে না পেয়ে কারণ জানতে চাইলে শুনেছিলাম তাঁর কান্নার গল্প। জয়ের আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়া সাদাত লিখতেই পারছিলো না কিছু। 

আমার বইয়ের প্রকাশক মিঠু। তরুণ তুর্কী। শুরু থেকে তার একটাই কথা, আকাশী নীল জিতবে। মেসি কাপ হাতে এই দৃশ্য সে না কি স্পষ্ট দেখতে পায়। মিঠুর চোখের জলও চিকচিক করে দলের জন্য। আমার অভিনেতা পুত্র অর্ক। আর্জেন্টিনার ক্লাব থেকে কিনে এনেছিলো ম্যারাডোনার জার্সির রেপ্লিকা। এবার সে জার্সি গায়ে চাপিয়ে কঠিন খেলাগুলো দেখেছে তার ধারণা এই ম্যাজিক কাজ করে, করবে। লুইসার বয়স বড়জোর পঁচিশ বা ছাব্বিশ। ভালো একটা কাজ করে। পোক্ত বস। কিন্তু খেলার সময় আকাশী নীলের জন্য মরিয়া। ঘন ঘন কফি পান করে মাঝে মাঝে স্বভাববিরুদ্ধ চোখে পানি টলমল করে ওর। এই যে আমি বয়সের কারণে টেনশন নিতে পারি না। তাই খেলাগুলো কিছুটা দেখি, কিছুটা বন্ধ রাখি। আর্জেন্টিনার গোল লাইনে বল গেলে চোখ বন্ধ করে অন্য ঘর ঘুরে আসি। আর জিতে গেলে? এক গোল দেখি কমপক্ষে দশবার। এই যে আমরা সাধারণ পাবলিক, এই যে বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী ও জনতা এরা কেউ বুয়েন্স আয়ার্স চেনে না, জানেও না। যায়নি যাবেও না কোনোদিন। মেসি মার্তিনেজ স্কালোনি কেউ আমাদের চেনে না। দুনিয়ার কয়েক শ কোটি মানুষের ভেতর ছোট্ট জোনাকীর মতো আমরা। তবু আপন আনন্দে আপন শক্তি ও ক্ষুদ্র আলোয় নিজেকে জ্বালিয়ে গাই, তুমি নও তো সূর্য নও তো চন্দ্র তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ? আমরা এটা জানি আমরা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কেউ না আবার আমরা ছাড়া ওরাও কেউ না। জয়তু আর্জেন্টিনা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক এই ভালোবাসা। লেখক ও কলামিস্ট